বাংলাদেশসহ ৬ দেশে অসুস্থ শিশুদের মৃত্যুর অর্ধেকই ঘটে হাসপাতাল ছাড়ার পর

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চলের ছয় দেশের স্বল্প ও মধ্যম আয়ের পরিবারের অসুস্থ শিশুদের মৃত্যুর অর্ধেক ঘটে হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে ছাড়া পাওয়ার পর।

আবার এই দেশগুলোর ২ থেকে ২৩ মাস বয়সী যে শিশুরা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে বা বেশি অপুষ্টিতে ভোগে, হাসপাতালে ভর্তির পরের ৬ মাস তারা মৃত্যুর উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান চাইল্ডহুড অ্যাকিউট ইলনেস অ্যান্ড নিউট্রিশন নেটওয়ার্কের (সিএইচএআইএন বা চেইন) এক গবেষণায় এ চিত্র পাওয়া গেছে। সম্প্রতি গবেষণা প্রতিবেদনটি বিশ্বখ্যাত দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ সাময়িকীতে প্রকাশ করা হয়েছে।

গবেষকেরা বলছেন, এসব মৃত্যু ঠেকাতে চিকিৎসাবিষয়ক নীতিমালা পর্যালোচনা করার পাশাপাশি বাড়িতে গিয়ে সেবা দেওয়ার বিষয়ে জোরালোভাবে ভাবতে হবে।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দুটি ও সাব সাহারা অঞ্চলের চারটি দেশের ৯টি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৩ হাজার ১০১টি বেশি অসুস্থ শিশুর ওপর এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে। এসব শিশুর মধ্যে ৩৫০টির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে।
বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশগুলো হলো পাকিস্তান, বুরকিনা ফাসো, কেনিয়া, মালাউয়ি ও উগান্ডা।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে শিশুদের উল্লেখযোগ্য অংশ (প্রতি পাঁচ শিশুর একটি) মৃত্যুর উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। এসব শিশুর হাসপাতালে ভর্তি, হাসপাতাল ত্যাগ, পুষ্টিগত অবস্থা ও সামাজিক অবস্থার তথ্যগুলো থেকে সহজেই হাসপাতাল ছাড়ার পর শিশুর মৃত্যুর বিষয়ে একটা আভাস পাওয়া যেতে পারে।

হাসপাতাল ছাড়ার পর মৃত্যু সম্পর্কে সহজে আভাস পাওয়া গেলেও বিষয়টির দিকে স্বাস্থ্যকর্মী বা সংশ্লিষ্টদের নজর নেই বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষকেরা এ-ও দেখেছেন, হাসপাতালে এমন অনেক শিশুকে ভর্তি করা হয়, যাদের মৃত্যুঝুঁকি খুবই কম।

হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার পর যেসব শিশুর মৃত্যু হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই অপুষ্টিতে ভুগছিল বলে জানতে পেরেছেন গবেষকেরা। অপুষ্টির শিকার এই শিশুদের মৃত্যুঝুঁকির পেছনে আরও কিছু কারণ ছিল। যেমন চিকিৎসাসেবা পাওয়ার সুযোগের অভাব, পারিবারিক সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি ও শিশুদের অন্যান্য শারীরিক জটিলতা। গবেষকদের ভাষ্য, শিশুদের এমন মৃত্যুঝুঁকি কমাতে চিকিৎসা ও পুষ্টিসংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি আর্থসামাজিক বিষয়গুলোসহ তাদের মায়েদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নজর দিতে হবে।

উগান্ডায় চেইনের গবেষক দলের নেতৃত্ব দেন মাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশুরোগ ও শিশুস্বাস্থ্যবিষয়ক বিভাগের চেয়ার ড. ইজেকিয়েল মুপেরে। তিনি বলেন, ভীষণ অসুস্থ শিশুদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনার পর চিকিৎসকেরা এই শিশুদের বাড়িতে ফেরত পাঠানোর পর কীভাবে তাদের যত্ন নেওয়া যায়, সে সম্পর্কে অভিভাবকদের বিস্তারিত নির্দেশনা দেন না। বাড়িতে যাওয়ার পর এসব শিশু নানা ঝুঁকির দুষ্টচক্রে পড়ে যায় ও কখনো কখনো তাদের মৃত্যু ঘটে।

গবেষক দলের প্রধান বলেন, ‘হাসপাতালে আনার পর প্রচণ্ড অসুস্থ শিশুদের শারীরিক অবস্থার প্রতি যেভাবে মনোযোগ দেওয়া হয়, সেভাবে মনোযোগ দেওয়া হয় না, তারা কোন পরিবেশ থেকে এসেছে বা কী কারণে তাদের শরীরের অবস্থা এতটা নাজুক হয়েছে, সেই বিষয়ের প্রতি।’

শিশুমৃত্যু কমাতে হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও বাড়িতে পাঠানো রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় মৌলিক পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছেন গবেষকেরা। তাঁরা মনে করেন, এই ব্যবস্থাপনা হতে হবে রোগীর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির ভিত্তিতে। হাসপাতাল থেকে যেসব শিশু ছাড়া পাচ্ছে, তাদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি মূল্যায়ন করা হতে পারে শিশুমৃত্যু ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

উপরন্তু উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গবেষকদের পরামর্শ, হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনা যেসব শিশুর মৃত্যুঝুঁকি অনেক কম তাদের শনাক্ত করা। এতে কম ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের কাছ থেকে স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্য পরিষেবা সরিয়ে অতিঝুঁকিতে থাকা শিশুদের জন্য নিয়োজিত করা যাবে বলে মনে করেন তাঁরা।

চেইনের অন্যতম গবেষক আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) নির্বাহী পরিচালক তাহমিদ আহমেদ বলেন, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অনেক শিশু মারা যাচ্ছে বলে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা দুঃখজনক। এসব দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু ঠেকাতে চিকিৎসা নীতিমালা পর্যালোচনার পাশাপাশি বাড়িতে গিয়ে সেবা দেওয়ার বিষয়ে ভাবতে হবে।